সুনামগঞ্জ , মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫ , ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে দুর্ঘটনা হাসি ফুটলো সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশু রুমেজার মুখে সাবেক এমপি নাছির চৌধুরী হাসপাতালে ভর্তি করোনায় একজনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ২৫ মোল্লাপাড়া ইউনিয়নে বিএনপি’র কর্মীসভা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ‘আমার কণ্ঠ আমার অধিকার’ ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত প্রতিপক্ষের হামলায় ছোট ভাই নিহত, বড় ভাই হাসপাতালে টাঙ্গুয়ার হাওর ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ নয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা চলবে না : আব্দুর রব ইউসুফি আলোচনা হলে সরকারের ‘ভাব’ বুঝতে পারবে ইসি : সিইসি হাওর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, গ্রেফতার ৭ জামালগঞ্জে ফুটবল টুর্নামেন্ট সম্পন্ন জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত উঠানে পড়েছিল যুবকের রক্তাক্ত লাশ : আটক ১ জামালগঞ্জে মাদক নির্মূলে গ্রামবাসীর প্রতিরোধ সভা: সর্বাত্মক সহযোগীতার আশ্বাস ওসি'র চৌধুরী মনসুর আহমদ আর নেই ভাতিজার হাতে চাচি খুন সিলেটের কোনো পাথর কোয়ারি আর লিজ দেওয়া হবে না : পরিবেশ উপদেষ্টা অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে বিপদে টাঙ্গুয়ার হাওর মরিচক্ষেতে মিললো গ্রেনেড, নিষ্ক্রিয় করলো সেনাবাহিনী
হাওরের কৃষি, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র এবং জীবনধারাও ঝুঁকির মুখে

১৮ সীমান্ত নদী ভরাটের পথে

  • আপলোড সময় : ২৩-০৪-২০২৫ ০৮:২০:৪৪ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৩-০৪-২০২৫ ০৮:২৮:৫৭ পূর্বাহ্ন
১৮ সীমান্ত নদী ভরাটের পথে
শামস শামীম, হাওরাঞ্চল ঘুরে ::
ভারতের পাহাড় থেকে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে নেমে এসেছে অসংখ্য খাল, ছড়া নদীমিশেছে অগনিত হাওরেএসব নদী খালসহ জেলার ভেতর প্রবাহিত অন্যান্য নদ নদী খালও দিন দিন পাহাড়ি ঢলে আসা বালু-পলিতে ভরাট হয়ে গেছেএর মধ্যে ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা ১৮টি নদীর অধিকাংশই ভরাটের পথে

​​​​নদী নালা খাল হারিয়ে যাওয়ায় হাওর-জলাভূমির প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, নদী ও খাল ভরাট হওয়ায় হাওরে বিলম্বিত হচ্ছে বর্ষা। এতে প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে ফসলহানির ঘটনা ঘটছে। ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে অবকাঠামো।
পরিবেশ গবেষকরা বলছেন, উজান ও ভাটিতে নদীপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে অনেক নদী খাল ও পাহাড়ি ছড়া। হাওরের প্রাণ প্রবাহ হিসেবে পরিচিত নদীপ্রবাহের ক্ষতি হাওরের কৃষি, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র ও জীবনধারাও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জলবায়ু সংকট এই ভোগান্তি আরো বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন প্রাণ-প্রকৃতি গবেষকরা। এ নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রিয় সংলাপের দাবিও পরিবেশবিদদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া-মেঘালয় পাহাড় থেকে জেলার অভ্যন্তরে ১৮টি নদীর উৎপত্তি। এছাড়াও ছোটবড়ো আরো শতাধিক ছড়া (নালা) বা খাল রয়েছে। উজান থেকে ভাটিতে পানিপ্রবাহের প্রধান মাধ্যম এসব নদী ও ছড়া। তবে ভরাট হতে হতে এখন শুষ্ক মওসুমেও নদী ও ছড়াগুলোকে চেনার উপায় নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে জেলায় সর্বমোট ১০৬টি নদী রয়েছে। অসংখ্য ছড়া বা নালা পাহাড় থেকে নেমে আসার কথা স্বীকার করলেও এর সঠিক কোনও পরিসংখ্যান পাউবোর হাতে নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছুদিন আগে জেলার খননযোগ্য নদ নদী ও খালের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রকল্প পাঠিয়েছে। সেখানে বন্যা প্রতিরোধ ও ফসল রক্ষায় এসব নদ নদী খাল খননের কথা জানিয়েছে তারা।
ওই তালিকায় ৪৩টি নদ নদী খালের প্রায় ৯২৫ কিলোমিটার খননের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই তালিকায় সীমান্ত নদী কংস, উবদাখালী, চেলা, খাসিয়ামারা খননের কথাও বলা আছে। তবে ছড়াগুলোর তালিকা ও খনন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি ওই প্রকল্পের প্রস্তাবে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এক সময় ওই নদী ও ছড়াগুলো খরস্রোতা ছিল। দৈনন্দিন জীবনে পানির প্রয়োজন মিটানোসহ কৃষিকাজের সেচ ও বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের সহজ ব্যবস্থা ছিল। দ্রুত পাহাড়ি ঢলের পানি ভাটির বিভিন্ন নদ নদী হয়ে মেঘনার মাধ্যমে সাগরে পতিত হতো। নৌ যোগাযোগও ছিল সহজ। তখন বন্যায় অবকাঠামোর ক্ষয়-ক্ষতি কম হতো।
হাওরের একমাত্র বোরো ফসলও সুরক্ষিত থাকতো। এখন আগাম বন্যায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে হাওরের কৃষকদের একমাত্র বোরো ফসল। বোরো ফসল রক্ষার নামে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে ভাটির অন্যান্য নদ নদী খালও বন্ধ করে দেওয়ায় স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশবিদরা ক্ষুব্ধ। এদিকে দৃশ্যমান এই ক্ষতির মাটির উর্বরতা ও প্রতিবেশও নষ্ট হচ্ছে। পানিপ্রবাহের বৈচিত্র ব্যাহত হচ্ছে। এর বড়ো প্রভাব পড়েছে হাওরের বাস্তুতন্ত্রেও।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে সুনামগঞ্জ জেলায় ১৮টি নদী নেমে এসেছে। এ নদীগুলোর আবার আন্তঃজেলা সংযোগও রয়েছে। এগুলো হলো আশাউড়া খাল, কংস, ডোবাইল, সোমেশ্বরী, উপদাখালী, বহর, জালিয়া, উমিয়াম, চিলাই, জালিয়াছড়া, যাদুকাটা, ধোপাজান, খাসিয়ামারা, সোনালী চেলা, মৌলা, ভোলাখালি, কুশিউড়া ও মরাচেলা।

সংশ্লিষ্টরা জানালেন, সবগুলো নদীই ছিল খরস্রোতা। এখন প্রায় সবগুলোই ভরাট হওয়ায় চেনাই যাচ্ছেনা নদীগুলোকে। বর্ষা এলে এই নদীগুলো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তখন পানি ধারণের স্থান না হওয়ায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট উপচে পরিস্থিতি বিপর্যয়কর করে তোলে। পাউবো’র সিলেট বিভাগের চূড়ান্ত নদ নদীর ওই তালিকায় উপর্যুক্ত নদীগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যরে নদী হলো বহর ও আশাউড়া নদী। বহরের দৈর্ঘ্য প্রায় ০.৪৬ কিলোমিটার এবং আশাউড়া নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ কিলোমিটার। দীর্ঘ দৈর্ঘ্যরে নদী সোমেশ্বরী, উপদাখালি ও যাদুকাটার যথাক্রমে ৬২, ৫১ ও ৩৭ কিলোমিটার। সরেজমিনে যাদুকাটা নদীর উৎসমুখে গিয়ে দেখাযায়, নদীটি ভরাট হয়ে প্রকৃতি বদলে গেছে। বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হচ্ছে মোটর সাইকেল। নদীটির চারদিকেই বিস্তৃত বালুর চর বা মাঠের মতো। কোথাও হ্রদ আকারে রূপ নিয়েছে। নির্বিচার পাথর ও বালু বাণিজ্যর কারণেই নদীর গতিপথও বদলে গেছে। শুধু তালিকাভুক্ত এই নদীগুলোই নয় পাহাড়ি ছড়া বা নালা বড়ছড়া, রাজাইছড়া, বুরুঙ্গাছড়া, লাকমাছড়া, রঙ্গাছড়াসহ বিভিন্ন ছড়া এখন দেখে আর চেনার উপায় নেই। এসব খরস্রোতা খালের কোথাও গবাদিপশু কোথাও শিশুরা খেলাধুলা করছে। এই ছড়াগুলোর পাশের পচাশোল, সমসার হাওরের বেশিরভাগ ভরাট হয়ে গেছে। এসব এলাকার পুকুরও ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে প্রতি বছরই ভেঙ্গে যায় সড়ক ও বসতবাড়ি। ছড়াগুলো ভরাট হওয়ার কারণে এমন হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

যাদুকাটা নদী তীরের আদি বাসিন্দা মেরিনা দিব্রা (৬৩) বলেন, আমার মা ও বাবা গল্প করেছেন এই নদী একসময় অনেক প্রবহমান ছিল। সারা বছরই পানি থাকতো। এখন এই নদী শুকনো মওসুমে শুকিয়ে মাঠ হয়ে যায়। ছোটবেলায় আমরা কখনো যাদুকাটাকে এভাবে দেখিনি।

বড়ছড়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৭০) বলেন, আমাদের বড়ছড়া খালটি সরাসরি ভারতের খাসিয়া পাহাড় থেকে নেমেছে। ৬০ বছর আগে দেখেছি এই খাল অনেক গভীর। প্রচন্ড পানির বেগ ছিল। কখনো এই খালের পানি কমতো না। এখন শুকিয়ে গেছে। এখন বর্ষার সময় পাহাড়ি ঢল এসে নদীতে পানি ধারণের ক্ষমতা না থাকায় আমাদের ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতি করছে।

একই গ্রামের মো. শাহজাহান (৫৫) বলেন, বড়ছড়া খালের এখন চিহ্ন নাই। ভরাট হয়ে গেছে। খুদাইয়া (খনন করে) দিলে ভালো হইতো।
একই গ্রামের বাসিন্দা কৃপেশ চক্রবর্তী (৭০) বলেন, বড়ছড়া খালের গভীরতা এক সময় অনেক বেশি ছিল। আমরা ভয়ে খালে নামতাম না। প্রচন্ড স্রোত ছিল। কিন্তু এখন দেখে চেনার উপায় নেই খালটিকে। পাহাড়ি ঢল আইয়া খালটি ভরাট কইরা নষ্ট কইরা দিছে। আমরা খেত কৃষিও নষ্ট করে।

হাওরের জীববৈচিত্র গবেষক কল্লোল তালুকদার চপল বলেন, এসব নদ-নদী ও খাল ভরাটের ফলে হাওরের মাটির উর্বরতা ও প্রতিবেশও নষ্ট হচ্ছে। পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় কৃষি ও বাস্তুতন্ত্রের উপরও প্রভাব পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সময় এই প্রভাব আমাদের জন্য আগামীতে চরম সংকট ডেকে আনবে। এ বিষয়ে আন্তরাষ্ট্রিক সংলাপও জরুরি। প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বহু পাহাড়ি ছড়া, ঝিরি, নালা, মৌসুমি প্রবাহ মিলে সুনামগঞ্জের নদীপ্রণালী জটিল করেছে। যার বেশিরভাগ অভিন্ন আন্তঃসীমান্ত নদী। উজান ও ভাটি সর্বত্র এই নদীপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উজানে মেঘালয় পাহাড়ে অপরিকল্পিত খনন, বন উজাড়, পাথর উত্তোলনের ফলে ভাটির বাংলাদেশে নদীপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আবার ভাটিতে নদী ও হাওর জলাভূমিতে বাঁধ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নির্বিচার পাথর ও বালুবাণিজ্যও নদীধারা বিলীনের কারণ। সুনামগঞ্জের নদীগুলো হাওর-জলাভূমির প্রাণ উল্লেখ করে এই গবেষক আরো বলেন, নদীপ্রবাহের ক্ষতি এখানকার কৃষি, প্রাণবৈচিত্র জীবনধারা সবকিছুকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। পাহাড়ি প্রবাহ বিলীনের ফলে নানিদ মাছ, লোচ মাছ, মহাশোল, পিপলিশোল, তারাবাইম, রানী, গুতুম, বাঘাইড় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। নদী না থাকায় হাওর-জলাভূমির প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হয়ে হাওরের জলাবন, হিজল-করচ বিকশিত হচ্ছেনা, গভীর পানির ধান হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে হাওরের যাতায়াত। দুনিয়ার সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ ভাটি অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বিচারে নদীর মৃত্যু, হাওর জলাভূমি দখল ও ভরাটের ফলে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ ক্ষমতা কমছে। এতে বন্যা ও জলাবদ্ধতা বাড়ছে। ফসলহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ বাড়ছে। জলবায়ু সংকট এই ভোগান্তি আরো বাড়াচ্ছে বলে জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাদুল হক বলেন, সুনামগঞ্জের সীমান্ত নদী ১৮টি। এছাড়াও অসংখ্য খাল ও ছড়া রয়েছে। এগুলো বালু ও পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে পানিপ্রবাহ কমেছে। এতে নানা ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আমরা নদ নদীগুলো খননের একটি প্রাথমিক তালিকা করে প্রকল্প জমা দিয়েছি।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে দুর্ঘটনা

অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে দুর্ঘটনা