অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে বিপদে টাঙ্গুয়ার হাওর
- আপলোড সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১১:৪৬:২৮ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৬-২০২৫ ১১:৪৬:২৮ অপরাহ্ন

শামস শামীম ::
বর্ষায় পর্যটকে মুখর হয়ে ওঠে হাওর-বাওর। আন্তর্জাতিক রামসার সাইট খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন পর্যটকদের মিছিল শুরু হয়েছে। ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটিতে ভিড় লক্ষ করা গেছে পর্যটকদের। অধিকাংশ হাউসবোট আগাম বুকিং হওয়ার পর হাওরের নিলাভ জলে ভেসেছেন তারা। তবে বর্ষাকালীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হাউসবোটে পর্যটকদের নিরাপত্তা, পরিবেশসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটকদের প্লাস্টিকের বর্জ্য এবং ডিজে পার্টির উচ্চ শব্দে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
টাঙ্গুয়ার সংক্ষেপ :
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওরটি দেশের ৬টি মাদার ফিসারিজের অন্যতম একটি। ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণার পর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি বিশ্বের ১০৩১টি রামসার সাইটের মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট ঘোষিত হয়। হাওরবাসীর আর্থ সামাজিক পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ, টেকসই ব্যবস্থাপনা ও হাওরের প্রকৃতিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবার পর ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আইইউসিএন রক্ষণাবেক্ষণে ছিল। যে লক্ষ্যে হাওর ব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছিল সুরক্ষার বদলে পরিবেশ ও প্রকৃতি ব্যাপক ধ্বংস হয় বলে অভিযোগ উঠে। দেশের মিঠাপানির অর্ধেক মাছের এই হাওর এখন মাছশূন্য। কমেছে গাছপালা ও সংরক্ষিত বনও। এই ধারাবাহিকতায় এখন উদ্বেগ পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাত।
দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ জলাভূমি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। ৯৭.২৯ ব.কি. আয়তনের হাওরটি ঘিরে আছে ছোট বড় ৮৮টি গ্রাম। গ্রামবাসী মৎস্য আহরণ, কৃষি পেশায় জড়িত। হাওরে রয়েছে ৫২টি বিল, ১২০টি কান্দা-জাঙ্গাল। ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৯৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশীপাখি, ২২ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী পাণী, ২৯ প্রজাতির সরিসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীসহ অসংখ্য স্থলজ, জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য টাঙ্গুয়ার হাওরকে সমৃদ্ধ করেছে। টাঙ্গুয়ার বিভিন্ন বিল কান্দার নামও ভারি চমৎকার, কাব্যিক ও এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভৌগোলিকতার প্রতিনিধিত্ব করছে। হাওরের সৌন্দর্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় হাওরের লেচুয়ামারা, বেরবেরিয়াসহ দুটি জলাশয়কে পাখির অভয়াশ্রম, চারটি জলাশয়কে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে। এসব এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে পরিচিত।
যেভাবে আকর্ষিত হলেন পর্যটকরা :
২০১৮ সালে ব্যবস্থাপনা শেষ হওয়ার পর এখন অনেকটা ‘অরক্ষিত’ আছে হাওরটি। এই সুযোগে পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। দেশ বিদেশের পর্যটকদেরও নজর কাড়ে হাওরটি। নিয়মিত শুটিং হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিনেমার। বাড়তে থাকে দেশি বিদেশি পর্যটকদের আনাগোণা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের কারণে টাঙ্গুয়া রূপ দেখাচ্ছে দেশি বিদেশি অগুণতি পর্যটকদের। টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে পর্যটন ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত পর্যটক ব্যবসায়ীরা নজর দিয়েছেন গত এক দশক ধরে। এর মধ্যে তারা আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন হাউসবোট তৈরি করে ছেড়েছেন হাওরে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বোটগুলোতে রয়েছে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা। যার ফলে স্বচ্ছল পর্যটকরা সপরিবারে ঘুরতে আসছেন হাওরটিতে। তারা হাওরটিতে মনের আনন্দে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে একান্তে সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন।
পর্যটন ঘিরে আছে ৫ শতাধিক হাউসবোট :
বর্ষা ও হেমন্তে ভিন্নরকম সৌন্দর্য্য নিয়ে পর্যটকদের চোখে ধরা দেয় টাঙ্গুয়ার হাওর। বর্ষায় নীলনোয়া মেঘালয়ের নিলাভ ছায়া প্রতিবিম্বিত হয় হাওরের নীলজলে। আসমানের রঙও তখন নীল হয়ে ওঠে। তাই নীলনোয়া দেশে হারাতে আসেন পর্যটকরা। পর্যটকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাতছানি দিয়ে ডাকে দুর্গম এলাকার এই হাওরটি। স্থানীয় শিশু কিশোররাও পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় জীবিকার পথ তৈরি করেছেন। ছোট ছোট নৌকায় চা পান বাদাম বিক্রি করেন তারা। ছোট নৌকা নিয়ে পর্যটকরা হিজল-করচের ফাঁকে ঘোরাঘুরি করেন। মুহূর্তগুলো ধরে রাখেন ক্যামেরায়। শীতে পাখি দেখতে আসেন বিপুল পর্যটক।
স্থানীয় হাউসবোট মালিকরা জানান, অনলাইন ভিত্তিক গ্রুপ বিভিন্ন ট্যুর পরিচালনা করে। তারা হাউসবোট মালিকদের কাছ থেকে ‘বোট বডি’ ভাড়া নিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা করে। তারা টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশাপাশি টেকেরঘাট খনি প্রকল্পের শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী লেক), যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, লাকমাছড়াসহ বিভিন্ন স্থান ঘোরাঘুরি করেন। এই গ্রুপগুলো নির্ধারিত দিনের সকাল থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত পর্যটকদের খাবারের ব্যবস্থা করে। প্রতিটি হাউসবোটে ১৫-৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রতি ৫-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে ট্যুর পরিচালনাকারী দলগুলো। হাউসবোটে এটাচ বাথ এমনকি কোনটিতে এসি’রও ব্যবস্থা আছে। তবে ইদানিং একাধিক হাউসবোটে অগ্নিকা-ের ঘটনায় পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করায় উপজেলা প্রশাসন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাউসবোট মালিকদের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর উপজেলার নৌ পর্যটন সমবায় সমিতির সভাপতি গোলাম রব্বানী বলেন, আমাদের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর উপজেলার হাউসবোট আছে দুই শতকাধিক। বাকিগুলো ঢাকাসহ দেশের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের। হাউসবোটে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
তাহিরপুরের ওয়াটারলর্ড হাউস বোটের স্বত্বাধিকারী এনায়েত হোসেন পাটোয়ারী বলেন, আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক ট্যুর পরিচালনাকারী দলগুলো নির্দিষ্ট ভাড়ায় বোট নিয়ে যায়। খাবার-দাবারসহ পর্যটকের সবকিছু দেখভাল করে তারা। এবার ঈদে ছুটি বেশি থাকায় ছুটির দিনগুলোর প্রায় প্রতিদিনই ট্যুর রয়েছে। এবার টাঙ্গুয়ার হাওরে বিপুল পর্যটক এসেছেন।
ঢাকার বাসিন্দা রোবাইয়াত অদিতি বলেন, আমি একাধিকার টাঙ্গুয়ার হাওর এসেছি। ছোট নৌকা থেকে শুরু করে হাউসবোটও চড়েছি। শীত মওসুমেও টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরেছি। যতবারাই আসি ভিন্নরকম সৌন্দর্য্য নিয়ে ধরা দেয় হাওরটি। গাছপালা, জল, পাখি, মাছ ও মেঘালয় পাহাড়ের ছায়া আমাকে বারবার মুগ্ধ করে।
পরিবেশবিদদের উদ্বেগ:
পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধির ফলে হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতির বিষয়টিও সামনে আসে। বিশেষ করে রামসার সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটকদের অবাধ যাতায়াতে বিধি-নিষেধ থাকলেও সেটা মানছেনা কেউ। অনেক প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলছেন অবাধে। সংরক্ষিত এলাকায় ডিজে পার্টিও করছেন অনেকে। ফলে সংরক্ষিত এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে আছে। বিভিন্ন সময় স্থানীয় লোকজন বস্তা বস্তা পলিথিন সংগ্রহ করে নিজ উদ্যোগে পোড়াচ্ছেন।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী আহমদ কবীর বলেন, ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে প্রচুর পর্যটক আসছেন প্রতিদিন। অসচেতন পর্যটকরা হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় ঘুরছেন। প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছেন। ডিজে পার্টি করছেন। যা হাওরের জীববৈচিত্র্য ও জনপদের মানুষের জন্যও ক্ষতিকর।
পরিবেশ আন্দোলনের নেতা সাইফুল আলম সদরুল বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য আগের চেয়ে কমেছে প্রচুর। তারপরও সুনামের কারণে আসছে মানুষ। সংরক্ষিত এলাকাকে পুরোপুরি সংরক্ষিত করে পর্যটকদের অন্যান্য এলাকায় যাতায়াত করা উচিত। কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। যে কারণে হাওরের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য, হাউসবোট মালিকদের জন্য এখনো সুনির্দিষ্ট কোনও নীতিমালাও নেই।
পরিবেশ কর্মী সালেহিন চৌধুরী শুভ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর ধ্বংসের দায় নীতি নির্ধারকদের। পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ মেয়াদে টাঙ্গুয়ার হাওরে লক ডাউন করা হোক।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য:
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাসেম বলেন, বছরে ৪-৫ লাখ পর্যটক আসেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন হাউসবোটগুলোতে বিশেষ সুবিধা থাকায় সপরিবারে আনন্দ উপভোগ করতে অনেকেই আসেন। আমরা বোটগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে কাজ করছি। তাদের জন্য নীতিমালা ও গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এটা মানার জন্য সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও দুর্ঘটনারোধে করণীয় বিষয়ে বিশেষভাবে নির্দেশনাসহ পরিবেশের দিকে নজর রাখার বিশেষ নির্দেশনা আছে। তবে টাঙ্গুয়ার হাওর যে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জলাভূমি এটা আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত।
তাহিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, এবার ঈদের ছুটি বেশি থাকায় পর্যটকদের আনাগোণা বেশি। তাই বেশিরভাগ বোটই এখন পর্যটক নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের থানা পুলিশসহ ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ পর্যটকদের নিরাপত্তা দেখছে। তাছাড়া হাউসবোট মালিকদেরকেও প্রতিটি ট্যুরের তথ্য রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ