সজল কান্তি সরকার::
সুনামগঞ্জ জেলাধীন মধ্যনগর উপজেলার ২টি ইউনিয়ন (বংশীকুন্ডা উত্তর ও দক্ষিণ) ও তাহিরপুর উপজেলার ২টি ইউনিয়ন (শ্রীপুর উত্তর ও দক্ষিণ) মোট ৪টি ইউনিয়নের আঠারোটি মৌজা জুড়ে অবস্থিত ‘টাঙ্গুয়া’ হাওর। যার আয়তন ২৬ বর্গ কিলোমিটার (৭০০০ হেক্টর ১০) এলাকা নিয়ে।
শুধু দালিলিক জলাভূমি ২৮০২.৩৬ হেক্টর। তবে বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার দখলি এলাকা (১২৬৫৫ হেক্টর) বেড়ে যায়। উত্তরে মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ‘ছড়া’ (ঝরণা) মিলিত হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। জনশ্রুতি আছে, ‘নয়কুড়ি কান্দা আর ছয়কুড়ি বিল’ নিয়ে টাঙ্গুয়া গঠিত। এ প্রসঙ্গে হাওরপারের স্থানীয় বয়বৃদ্ধ অনেকেই বলেছেন, শতাধিক বিলের নাম শুনেছি একসময় তবে এখন প্রধান প্রধান বিল আছে- চট্টান্নিয়া বিল, রউয়া বিল, লেচ্যুয়ামারা বিল, রূপাভূই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়ার বিল, বাউল্লারডুবি বিল, বান বিল, তেকুন্নিয়া বিল, আইন্না বিল, সামসাগর বিল, সোনাডুবি বিল, টানের বিল, খাজ্জুয়াউরি বিল, নাবাই বিল, বটকাই বিল, বাউয়ার বিল, পাকেরতলা বিল, সরিয়াকুড়ী বিল, আরবিয়াকোনা বিল, পালাইর বিল, মতিয়ান বিল, নলকাটি বিল, রাক্কুয়ালের ডুবা বিল, নলচুঙ্গি বিল, দীঘিরপাড় বিল, আলংডোয়ার, মইশাউরি বিল, হাডা বিল, নয়াল বিল, শালদীঘা বিল, কলমা বিল, কৈয়েরকুড়ি বিল, ফুরি বিল ও মুক্তারখলা বিলসহ ৫০-৬০টি। টাঙ্গুয়া হাওরের একদম তীরবর্তী গ্রাম আছে ৫২টি- নিশ্চিন্তপুর, বংশীকুন্ডা, বাসাউড়া, হাতপাঠন, নয়াবন্দ, ঘাসী, সানুয়া, মাকরদি, শিশুয়া, কাউহানী, বীরসিংহপাড়া, চাপাইতি, উত্তেরগাঁও, নওয়াগাঁও, কুষ্ঠিবাড়ি, মাহমুদপুর, মোয়াজ্জেমপুর, বান্দাচাপুর, ডুমাল, গোয়াবাড়ি, লামাগাঁও, অমিতপুর, রামসিংহপুর, শিববাড়ি, হুকুমপুর, জানজাইল, ভবানিপুর, মানিকখিলা, পাটাবুকা, সুলেমানপুর, পূর্ব নিশ্চিন্তপুর, আনন্দ নগর, পাটিচুরা, জয়পুর, মন্দিপাতা, গোলাবাড়ি, সিলাইন তাহিরপুর, শিরের গাঁও, ইন্দ্রপুর, রাজেন্দ্রপুর, শাল্লিয়ানি, বাকাতলা, রূপনগর উত্তর, রূপনগর দক্ষিণ, কান্দাপাড়া, আন্তরপুর, সাউদপাড়া, কার্তিকপুর, দাতিয়াপাড়া, আমানিপুর, খিদিরপুর ও রংচি।
টাঙ্গুয়া হাওরের পাড়ে-পাড়ে গ্রাম আছে ৪৪টি- দক্ষিণউড়া, বাট্টা, কাকরহাটি, হামিদপুর, বাঘেরপাড়া, সাতুর, ডাইলাকান্দা, গোলকপুর, গোলগাঁও, রামপুর, লতিফপুর, পলোমাটি, সরবাড়ি কান্দাপাড়া, চারাগাঁও, বাগলি, মাঝেরছড়া, বিনোদপুর, রতনপুর, আকতারপুর, সোনাপুর, শ্রীপুর উত্তর, শ্রীপুর দক্ষিণ, তড়ং, তেলিগাঁও, বান্দাচাপুর, দুলুভপুর, জীবনপুর, সন্তোষপুর, উমেদপুর, শাহগঞ্জ, মাটিয়ান, রতনশ্রী, বরদল, মির্জাপুর, নবাবপুর, ইচামারি, কলাগাঁও, বাঁশতলা, বাঙালভিটা, লামাকাটা, বড়ইগাঁও, পীরেরগাঁও, মইয়াজুরী। সর্বমোট (৫২+৪৪) = ৯৬টি গ্রাম আছে। (২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ফিল্ডওয়ার্ক তথ্য অনুযায়ী) টাঙ্গুয়া হাওরের জলাভূমিতে ২০৮ প্রজাতির পাখি আছে, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভয়চর প্রাণি, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ ও ২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদ। এই হাওর ধান চাষাবাদের চেয়ে মাছ-পাখি ও বন-বনানীর জন্য প্রসিদ্ধ। টাঙ্গুয়ার হাওরে দুর্লভ প্রজাতির প্যালাসিস ঈগল, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (লাল ঝুটি), পিন টেনল (ল্যাঞ্জা হাঁস), সভেলার (খুন্তে হাঁস), মালার্ড (নীলমাথা হাঁস), পিয়াং হাঁস (গাডওয়াল), ঠাফটেউ (টিকি হাঁস), কনপিগমি (ধলা বালি হাঁস), বেগুনি কালেম, ডাহুক, পান মুরগি, সরালি, রাজসরালি, পাতি মাছরাঙা ও চখাচখির মতো পাখির দেখা মিলেছে। নয়নাভিরাম জলারণ্যে মিঠাপানি ও স্বাদু মাছের এই হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। দুর্গম হাওরে বসতির শুরুতে অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে কুচবিহার, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে অষ্ট্রোমঙ্গোলীয়ান জাতি-গোষ্ঠী গারো, নাগা, কুকি, কৌম, কোচ, হাজং, রাজবংশী সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করে। তারা বাসগৃহের পাশাপাশি জীবিকার তাগিদে মাছ শিকারের জন্য জলাশয়ে টুঙ্গি তৈরি করতো। টুঙ্গি (উড়াবপড়ঃ, ঐরময চষধঃভড়ৎস) (তৎসম বা সংস্কৃত; তুঙ্গ) এর বাংলা ব্যবহারের নানা উদাহরণ রয়েছে। সাধারনত টুঙ্গি শব্দের বাংলা অর্থ মঞ্চের উপর নির্মিত কুঠির বা ক্ষুদ্র গৃহ। উঁচু মাচা বা মাচান। আর জলটুঙ্গি বলতে জলাশয়ের মধ্যে তৈরি গৃহ। টাঙ্গুয়ার হাওরের নামকরণ নিয়ে এপর্যন্ত দালিলিক কিছু জানা না গেলেও এ-নিয়ে জনশ্রুতি আছে- “টুঙ্গি থেকে টাঙ্গুয়া।” “আমার বাড়ি আছে বন্ধু জলটুঙ্গির বাসা নিশিকালে আইসো তুমি খেলাইব পাশা।” একসময় জল আর অরণ্যের সমারোহে এই হাওরাঞ্চল জুড়েই ছিল জীব-জন্তুর দাপট। জলাশয়ে ছিল জলজ-উদ্ভিদের আধিপত্য। এক হাওর থেকে অন্য হাওরে নৌকাযোগে যাতায়াত করা ছিল সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক। জনবসতি ছিল পাহাড়ের পাদদেশে ও উঁচুভূমিতে কদাচিৎ। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ছিল অতি দুর্গম। তখন কৃষি ব্যবস্থার চেয়ে মাছ শিকার করে জীবন ধারণ ছিল সহজবোধ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে কাট্টুয়া (বড় কাট্টুয়া, চিপ কাট্টুয়া, ফুল্যিয়া কাট্টুয়া, জামা কাট্টুয়া, কড়ি কাট্টুয়া, পুরা কাট্টুয়া, হলুদ কাট্টুয়া), কাছিম (হলুদ কাছিম, জাত কাছিম, ধুম কাছিম, জল কাছিম), সিম, পাখি ও মাছ সহজেই শিকার করা যেতো। তাই বসতি থেকে অতি দূরবর্তী টাঙ্গুয়ার হাওরে শিকার করতে আসা জেলেরা শিকারের সুবিধার্থে দিনমান বা তারও অধিক সময় থাকতে গিয়ে বাঁশ দিয়ে জলের উপড়ে গড়ে তুলতো ‘টুংগি’ বা ‘টাংগি’। এতদাঞ্চলে জলাশয় বেষ্টিত টুল আকৃতির উঁচু স্থানকে টুংগি, টাংগি বা টাংগো বলা হয়। জলাশয়ের উপর নির্মিত এসব টাংগি শেলটার বা মাছ শুকানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তৎকালে ছিল একমাত্র উপায়। জনজীবনে এসব টাংগির ব্যবহার থেকেই বুধ করি এ জলাশয়ের নামকরণ হয় টাঙ্গুয়া। আবার সমসাময়িক নানা গীতিকায়ও ‘টুঙ্গি’ বা ‘জলটুঙ্গি’-এর উল্লেখ আছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার জলটুঙ্গি ধনী বিলাসী লোকদের বিশ্রাম ও প্রমোদ ঘর হিসেবেও বিবেচিত। “সুন্দর রাজার কন্যা বিয়া করাইব। জলটুঙ্গী ঘর এক বানাইয়া দিব। কতেক দাসী দিব তোমার সঙ্গতি করিয়া। সুখের রাজত্বি কর এইখানে থাকিয়া।” (পূ.গী.চ.খ.দ্বি.স. পৃ ১৯৮) তবে হাওরাঞ্চলে জেলেদের রাত্রিযাপন ও মাছ ধরে জিওল রাখা ও শুকানোর জন্য এই (জল) ‘টুংগি’ বা ‘টাংগি’ ‘প্রমোদ ঘর’ নয়, ছিল জীবনের প্রয়োজনে একমাত্র ভরসা। এখনও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে টুংগি বা টাংগি তৈরি করে মাছ শিকারও শুকানোর পদ্ধতি চালু আছে। তাই ধারণা করা হয় বা জনশ্রুতি আছে পাহাড়ের কাছাকাছি টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ধরার নিমিত্তে নাগা, কুকি, খাসিয়া ও কুচগারোদের দ্বারা অধিক ‘টুংগি’ বা ‘টাংগি’ গড়ে ওঠার কারণেই হয়তো এই হাওরের নাম হয় টাংগুয়া বা টাঙ্গুয়া। টাঙ্গুয়ার হাওরের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি ফসলরক্ষা বাঁধের নামও ‘টুঙ্গিবাঁধ’। এটি আদিবাঁধ ও অপেক্ষাকৃত টান এলাকা। ধারণা করা হয় এখানেও মাছ শিকারের সুবিধার্থে ‘টুঙ্গি’ তৈরি করা হতো। যা বাঁধের নামকরণের অন্যতম কারণ। এনিয়ে কথা হয় টাঙ্গুয়া পাড়ের কৃষি ও মৎস্য পেশায় জড়িত সত্তর বছর বয়ষোর্ধ এগারোজনের (নূরনবী তালুকদার, মিরাজ আলী, মো. সাদেক, উপেন্দ্র সরকার, রমেশ দাস, শৈনেন তালুকদার, গোলাম জিলানি, সইফুল মিয়া, আব্দুল জলিল, আব্দুল মান্নান ও হাদিস তালুকদার) সাথে। তারাও টুঙ্গি থেকে টাঙ্গুয়া নামকরণের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। তাছাড়া সুনামগঞ্জ জেলাধীন দিরাই উপজেলার তাড়ল ও কোলঞ্জ ইউনিয়নে ‘টাংনী’ নামে একটি হাওর আছে। যেখানে এককালে মাছের আধিক্য ছিল। যার নামকরণও এরূপ হবে বলেই স্থানীয়দের মতে যুক্তিযুক্ত। তবে, যদ্দূর মনে পড়ে ১৯৮২-৮৫ দিকে ভাটিময়ালে জেলেদের মুখেও আমি ‘টুঙ্গি’ নামটি অনেক শুনেছি। একসময় (১৯৭০-৮৫) হাওরে অধিক জনবসতির ফলে বন-জঙ্গল কমে যায়। ফলে জ্বালানি কিংবা বসবাসের বাঁশ-কাঠ সংগ্রহের জন্য বর্তমান টাঙ্গুয়ার হাওরেই ছিল আশেপাশে ময়ালবাসীর একমাত্র উৎস। গিরস্থরা নৌকা নিয়ে দু’একদিন পরবাস বা জিরাত করে টাঙ্গুয়া থেকে বন-বাঁশ-কাঠ সংগ্রহ করতো। যাকে ‘টুঙ্গিকাম’ বা ‘বাল্লাকাম’ বলা হতো। তখনও মৎস্য শিকারের নিমিত্তে অনেক টাংগি বা টুংগি ছিল। গিরস্থদের মুখে-মুখে শুনেছি এসব ‘টুঙ্গি’র কথা। টুঙ্গিকাম নিয়ে লোকশ্রুতি আছে। “গিরস্থের পুত বাল্লা যায় মুখ লুকাইয়া কান্দে মা’য়।” “বাঘে খায় কল্লা নাম তার বাল্লা।” “কামে গেলে টঙ্গি লগে নিও সঙ্গি।” জ্বালানি হিসেবে ‘বল্লুয়া’ এর খুব সুনাম। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রচুর বল্লুয়া ছিল যা সহজে ও নিরাপদে সংগ্রহ করা যেতো। ‘বল্লুয়া’ সংগ্রহের স্থানকেই ‘বাল্লা’ বলা হতো। বাল্লা থেকেই ‘বাল্লাকাম’ নামকরণ হয়। ঠিক তদ্রুপ ধরে নেওয়া যায় ‘টুঙ্গি’ বা ‘টাঙ্গি’ শব্দটিরই পরিবর্তিত রূপ ‘টাঙ্গুয়া’।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
টাঙ্গুয়া হাওরের নামকরণ
- আপলোড সময় : ১৮-০৬-২০২৫ ০৩:১৬:০৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৮-০৬-২০২৫ ০৩:৩৬:২৪ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ