সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে বাদানুবাদ। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা অনেকটা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি নিয়ে আওয়াজ বাড়ানোর চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ইসলামি দল।
তাদের সঙ্গে একাত্মতা রয়েছে আরও কিছু মধ্যমপন্থার ছোট দলেরও। তবে সবচেয়ে বড় দল বিএনপিসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দল এই পদ্ধতির ঘোর বিরোধী। এমনকি এই আওয়াজকে নতুন করে ষড়যন্ত্র হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন তারা।
এদিকে রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নয়। এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন। চালু করলেই একনায়কতন্ত্র সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। এর সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও রয়েছে। জাতীয় সংসদের নিুকক্ষে তো এটি সম্ভব নয়। উচ্চকক্ষে হয়তো করা যেতে পারে। সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়টি উঠে আসে।
এমনটি ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের মাঠ তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। তবে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। তবে নতুন করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন এই ইস্যুতে আওয়াজ বড় করছে। ইসলামী আন্দোলন ঢাকায় মহাসমাবেশ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চেয়েছে। যেখানে একই সুরে কথা বলেছে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি ছোট দল। মূলত এই সমাবেশের পর থেকেই পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে।
পিআর পদ্ধতিতে ভোটের বিরোধিতা করা বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। সমাবেশ থেকে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনকে জনগণের দাবি উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন,
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না। একই অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ কোনো নির্বাচন গ্রহণ করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
জবাবে বিএনপি বলছে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্যই এই ইস্যুকে ইচ্ছাকৃতভাবে সামনে আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন পদ্ধতিতে নির্বাচন কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। যদিও বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোট দাবির পেছনে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে। দলটির নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, নির্বাচন নিয়ে নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে এলে পতিত সরকার আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পিআর পদ্ধতিতে ভোটে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার দাবি প্রসঙ্গে তারেক রহমান দেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতিতে ভোট করা কতটা উপযোগী তা নিয়েও চিন্তা করার কথা বলেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। যারা পিআর সিস্টেমে নির্বাচন চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন বিলম্ব অথবা নির্বাচন বানচাল করতে চায় তারা। পিআর ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারীরা দেশের আদর্শে বিশ্বাসী নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। তিনি বলেন, আজ কেন এই দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন এসেছে পিআর নিয়ে। পিআর পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু এটিকে ইস্যু করে দেশের মানুষের গণতন্ত্রের যে আকাঙ্খা তাতে যদি কেউ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, তা হলে তারা দেশের আদর্শে বিশ্বাস করে না। তারা নিজের আদর্শে বিশ্বাস করে, তাদের নিজেদের দলীয় আদর্শে বিশ্বাস করে।
পিআরে ভোট আরও বেশি স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার ভাষায়, এতে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করা ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, পিআর দাবি নিয়ে নির্বাচন পেছিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটি একটি সাময়িক ইস্যু। অচিরেই এটি চাপা পড়ে যাবে। পিআর পদ্ধতি কি : এ পদ্ধতিতে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পায়, তার অনুপাতে সংসদে আসন পায়।
দেশের বর্তমান সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ যদি কোনো দল মোট ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তা হলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। তথ্য অনুযায়ী, প্রথমবার ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে চালু হয় পিআর পদ্ধতি।
বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ দেশে, পিআরভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মিশ্র পদ্ধতি বেশ জটিল প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকদের অভিমত : নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম বলেন, পদ্ধতির ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। যারা নির্বাচনে অনেক ভোট পেয়েও কাক্সিক্ষত আসন পায় না তারা এটি চাচ্ছে। গোটা নির্বাচনে কোনো দল যদি এক শতাংশ ভোট পায় তা হলে তার আসন সংখ্যা হবে তিনটি। যা অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর জন্য অনেক বড় অর্জন বৈকি। বড় দলগুলো এর বিপরীত অবস্থানে। কারণ তারা যদি কোনো কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তা হলে অন্যের সহায়তা নিতে হবে। এগুলো তখন নানা সমীকরণে চলে যাবে। নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজন হবে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে প্রার্থীদের সঙ্গে স¤পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকে না। কারণ মানুষ তখন দলকে ভোট দেয় ব্যক্তিকে নয়। এখন তিনি বলেন, ছোট দলগুলো চাইলে এটি ঐকমত্য কমিশনের সভায় আলোচনা করতে পারে। বাইরের আলোচনায় ঐক্য বিনষ্ট করবে। এতে কারোর ফায়দা নেই। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ-উর রহমান বলেন, বাংলাদেশে তো এটি সম্ভব নয়। নিম্নকক্ষে করা যাবে না। এটি কয়েকটি রাজনৈতিক দল অহেতুক কেওয়াজ তৈরি করছে। পিআর পদ্ধতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনায় নেই। বাইরে থেকে আওয়াজ তোলা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও পিআর পদ্ধতি নেই। আছে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল কিছু ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চালু করে মুশকিলে পড়েছে। এখন তারা আবারও আগের অবস্থায় ফিরছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার মনে করেন, জাতীয় ঐকমত্য হলে আনুপাতিক বা পিআর নির্বাচন বাস্তবায়ন সম্ভব। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারি মনে করেন, এখনই আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন করা ঠিক হবে না। এটি অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
অন্তত ১৫-২০ বছর সময় দরকার। আনুপাতিক পদ্ধতির ধারণা খারাপ নয়। এ চিন্তাকে স্বাগত জানাই। তবে হঠাৎ তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, অনেকে অনেক প্রস্তাব দিতে পারে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করেও একনায়কতন্ত্র ঠেকানো যায় না। শ্রীলঙ্কা তার বড় উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। সুতরাং আনুপাতিক পদ্ধতি চালু করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আমার মতে, আরও ভালো পদ্ধতি হলো ইরান, ফ্রান্সসহ আরও অনেক দেশে দুই ধাপে নির্বাচন হয়। প্রথম ধাপে সবাই প্রার্থী হতে পারেন।
এ ধাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোট না পেলে দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচন করতে পারবেন না। এখন বাংলাদেশে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন চালু করতে গেলে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে মানতে হবে। যদি না মানে তা হলে তো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
পিআর পদ্ধতি নিয়ে নতুন বাদানুবাদ
- আপলোড সময় : ০৪-০৭-২০২৫ ১০:৩৫:০৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৭-২০২৫ ১০:৩৯:২৩ অপরাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ