নৃশংস হত্যাকান্ডে জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক
- আপলোড সময় : ১০-০৮-২০২৫ ০৮:৩২:৪১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১০-০৮-২০২৫ ০৮:৩২:৪১ পূর্বাহ্ন

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
গাজীপুরে তরুণ সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুরে ব্যবসায়ী সাইদুর রহমানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এর একদিন আগে গত বুধবার গাজীপুরের আরেক সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভের হাত-পা ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়। পুলিশ আর শত শত মানুষের সামনে তার বুকের ওপর উঠে সন্ত্রাসীদের নৃত্য করার ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ডে জনমনে ক্রমেই বাড়ছে উদ্বেগ, আতঙ্ক; ছড়িয়ে পড়ছে ভীতি। - এমনটাই বলছেন সাধারণ মানুষ।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। হত্যা, ছিনতাই, অপহরণ, লুটপাট ও মবসন্ত্রাসের ঘটনাগুলো সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট করে তুলেছে। নৃশংস অপরাধের পর রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ করেছে; জানিয়েছে তাদের দলীয় অবস্থান। কিন্তু এর পরও হত্যা, ছিনতাই, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা থামছে না। কারণ হচ্ছেÑ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবে না, এটি অপরাধীরা বুঝে গেছে। তাই অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। গড়ে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন মানুষ খুন হচ্ছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। মার্চে সারাদেশে ৩১৬ জন খুন হয়েছেন। এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে।
খুনের পাশাপাশি সারাদেশে ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও কমছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এ ছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি ঘটনা ঘটেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, প্রকাশ্যে নৃশংস হত্যাকান্ডের ফলে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নৃশংস ঘটনা আশপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। এখন প্রত্যেকেই যে যার মতো ভালো থাকার চেষ্টা করার ফলে সমাজে এসব ঘটনার সম্মিলিত প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে না। এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম শর্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। সেটা করতে না পারলে নির্বাচনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে জোরালোভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবৈধ বলপ্রয়োগের কারণে তাদের অনেকেই নিজেদের অপরাধী মনে করে। তাই এখন বৈধ আইন প্রয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে পুলিশ। তিনি বলেন, আইনগত অধিকার প্রয়োগে পুলিশ এখন দ্বিধাগ্রস্ত।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীর মধ্যে ভয়হীনতার বোধ সৃষ্টি হলে অপরাধের মাত্রায় নৃশংসতা বাড়ে। নিজেদের ক্ষমতা আর প্রভাবের জানান দিতে অপরাধীরা এ ধরনের নৃশংসতা ছড়ায়। এসব ভয়াবহতা ঠেকাতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
একাধিক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অন্যায়ের শিকার হলে যে দ্রুতই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাবেন, তারা এমন ভরসা পাচ্ছেন না। সামাজিকভাবে এসব কা- প্রতিরোধেও কেউ এগিয়ে আসছেন না। প্রকাশ্যে মানুষের সামনে হত্যাকান্ড সহ নৃশংস ঘটনার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব দেখে ভয় ও আতঙ্ক আরও বাড়ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ভেঙেপড়া একটি বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি খুন, ৪ হাজার ১০৫টি ধর্ষণ এবং পুলিশের ওপর হামলার ৫২০টি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কার্যকর করতে সরকারের পদক্ষেপ অনেকটাই কাগুজে। বাস্তবে পুলিশের মনোবল ফেরানো, কার্যকর অপরাধ দমন কৌশল প্রণয়ন এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে কার্যকর, সাহসী ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, গত বুধবার গাজীপুর মহানগরের সাহাপাড়ায় পুলিশের সামনেই পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে। তার মুখ ও মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়; থেঁতলে দেওয়া হয় পা। তার বুকের ওপর উঠে লাফালাফি করেছে সন্ত্রাসীরা। সাধারণ মানুষের মতো পুলিশও হামলা থেকে আনোয়ারকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। এ ছাড়া সম্প্রতি ধানমন্ডি এলাকা থেকে ছিনতাই করে চাপাতি হাতে পুলিশের সামনে দিয়েই অপরাধীকে চলে যেতে দেখা যায়। পথচারী ও পুলিশ কেউ তাকে বাধা দেয়নি। -আমাদের সময়
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ