
সুনামগঞ্জ জেলার সড়কপথ যেন ক্রমেই পরিণত হচ্ছে মৃত্যুর ফাঁদে। চলতি বছরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩৩ জন, আহত হয়েছেন আরও ৪৬ জন। এসব প্রাণহানির বেশিরভাগই অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনার পরিণতি। এটি নিছক একটি পরিসংখ্যান নয়- এগুলো বাস্তব, হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি; প্রতিটি মৃত্যু একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ।
আমরা প্রতিনিয়তই শুনে আসছি সড়কে মৃত্যুর এই ভয়াবহতার খবর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, প্রশাসন, পরিবহন মালিক, চালক এবং সাধারণ মানুষের একাংশের দায়িত্বহীনতা এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে। অদক্ষ চালকের হাতে যানবাহনের চাবি তুলে দেওয়া, রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির চলাচল, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের রাস্তায় নামা - এসবই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আমরা দেখছি, বিআরটিএ’র দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষের বিনিময়ে অনায়াসে মেলে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ। এসব অনিয়ম না থামালে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অথচ এসব অভিযোগকে বারবার ভিত্তিহীন বলে এড়িয়ে যান কর্মকর্তারা। তাদের কাছে প্রশ্ন, যদি ব্যবস্থা গ্রহণই হয়ে থাকে, তবে কেন সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা?
এছাড়া, ট্রাফিক পুলিশের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও পর্যাপ্ত নয়। লোকবল সংকট, সুপারিশের চাপ এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তারা অনেকসময় অভিযানে কার্যকর হতে পারেন না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এমন অসহায় চেহারা দুর্বৃত্তদের সাহস জোগায়। পাশাপাশি, আমাদের অভিভাবকদের উদাসীনতাও একটি বড় কারণ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোটরসাইকেল বা পিকআপ তুলে দেওয়ার মানে তাকে নিজের কিংবা অন্যের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া।
এ অবস্থায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস প্রক্রিয়ায় শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে এবং ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে। মালিকদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, কারণ তারা নিজেরা এসব চালক নিয়োগ দেন। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত বাধ্যতামূলক করে দায়ীদের চিহ্নিত ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মামলা হলে তার অগ্রগতি ও রায় জনগণকে জানাতে হবে, যাতে উদাহরণ সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক প্রভাব ও তদবিরের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক বলিষ্ঠতা প্রয়োজন। আইনের চোখে সবাই সমান - এই বার্তাটি বাস্তবায়নেই থাকবে জনগণের আস্থা।
আমরা মনে করি, একটি সভ্য সমাজে সড়ক দুর্ঘটনা কেবল “দুর্ঘটনা” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, যদি তা প্রতিরোধযোগ্য হয়। সড়কে প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আর কতো প্রাণ গেলে আমাদের বিবেক জাগবে? এখনই সময় জবাবদিহিতার, সততার এবং কঠোর ব্যবস্থার। নইলে এই মিছিল থামবে না, কেবল শোকের পাল্লা ভারি হবে।