
টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু একটি প্রাকৃতিক জলাশয় নয়, এটি বাংলাদেশের এক অপরূপ জীববৈচিত্র্য ভা-ার, দেশের ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃত এক গৌরবময় পরিবেশস¤পদ। এ হাওর প্রাণ দেয় পাখিকে, মাছকে, গাছপালাকে; আর উপার্জনের পথ করে দেয় হাজারো স্থানীয় মানুষের জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এই হাওর যেন প্রাণ হারাচ্ছে পর্যটনের নামে অব্যবস্থাপনা, দূষণ আর লাগামহীন বাণিজ্যিকীকরণের চাপে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ, বিশেষ করে হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় হাউসবোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাচ্ছে।
পর্যটনের নামে হাওরের বুক চিরে চলা ইঞ্জিনচালিত নৌযান, উচ্চ শব্দে গান-বাজনা, ক্যাম্পফায়ার, প্লাস্টিক-জাতীয় বর্জ্য ফেলা এবং পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘœ - এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকা- এতদিন অবলীলায় চলেছে। হাওরের শান্ত, সংবেদনশীল পরিবেশে এইসব কার্যকলাপ শুধু জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং হাওরের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।
আমরা মনে করি, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের জারি করা ১৩ দফা নির্দেশনা এবং ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় হাউসবোট চলাচল স্থগিতের ঘোষণাটি তাই শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি একটি দায়িত্বশীল বার্তা। এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই, তবে পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। কেবল নির্দেশনা জারি করলেই চলবে না - তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নও করতে হবে। হাওরে চলাচলকারী নৌযানগুলোর নিবন্ধন, লাইসেন্স, রুট নির্ধারণ, স্থানীয় গাইড বাধ্যতামূলককরণসহ একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবেশবান্ধব পর্যটন নীতিমালা এখন সময়ের দাবি।
সবচেয়ে বড় কথা, এই হাওর রক্ষা করতে হলে স্থানীয় জনগণকেই মূলভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। স্থানীয়দের বাদ দিয়ে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণে তাদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃত রক্ষা সম্ভব হবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর বাঁচাতে চাইলে এর ভেতরের ‘কোর জোন’কে অবশ্যই সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে মান্যতা দিতে হবে। এছাড়া পর্যটন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, মনিটরিং সিস্টেম ও জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু সুনামগঞ্জবাসীর সম্পদ নয়, এটি জাতীয় ঐতিহ্য, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের রেখে যাওয়া একটি দায়িত্ব। প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এই দায়বোধের প্রতিচ্ছবি। এ উদ্যোগ যেন আরও সুসংহত, কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় -সেই প্রত্যাশাই করি।
পরিশেষে বলি- হাওর বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে। আর প্রকৃতি বাঁচলেই বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে সংস্কৃতি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ।