মদ্যপ তরুণীর ভিডিওচিত্রে ভাইরাল টাঙুয়া:হাউসবোটে হতশ্রী হাওর

আপলোড সময় : ০৯-০৭-২০২৫ ০১:২৭:০৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ০৯-০৭-২০২৫ ০১:৩৯:৪০ পূর্বাহ্ন
* নির্দেশনা কাগজে-কলমে
* বাণিজ্যিক স্বার্থে খোলামেলা মডেলিং
বিশেষ প্রতিনিধি ::
টাঙ্গুয়ায় ঘুরতে আসা তরুণীর মদ্যপ ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এতে হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশ দূষণ ও সামাজিক অস্থিরতার বিষয়টি ফের সামনে চলে এসেছে। এছাড়া পর্যটকবাহী হাউসবোটে মাদক সরবরাহ সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা কিছুটা হলেও প্রমাণিত হয়েছে।

এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, পরিবেশকর্মী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উত্তরের পাহাড়ী ঝর্ণা নিঃশ্বাস ছেড়ে টাঙ্গুয়ার বহমান মুক্ত পরিবেশকে স্বাধীন রূপ দিলেও মানুষের তান্ডবে হতশ্রী গোটা হাওর। পাহাড়, প্রকৃতি, জল, জমিনে গর্বিত টাঙ্গুয়া প্রতিনিয়তই নিষ্পেষিত হচ্ছে। তবে হাওর সুরক্ষায় আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
 
জানাযায়, টাঙ্গুয়া নিয়ে গত ২২ জুন জেলা প্রশাসন জরুরি নির্দেশনা জারি করে। তবে প্রশাসনের এ নির্দেশনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ বলছেন কেউ কেউ। ২৫ জুন রাতে টাঙ্গুয়ায় গাঁজা সেবন করে বিশৃঙ্খল আচরণের দায়ে পাঁচ পর্যটককে দন্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত রোববার বাবুল নামের এক মাদক কারবারিকে মদ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাও হয়েছে। প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ সাময়িকভাবে ‘দৃষ্টি আড়ালে’র চেষ্টা দাবি সচেতন মহলের।

মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলায় বিস্তৃত ১২ হাজার ৬৬৫ হেক্টর আয়তনের টাঙ্গুয়ায় ১৮ মৌজা, ৫১ হাওর, ৫৪টি ছোট-বড় বিল আছে। মিঠাপানির বৃহত্তম এ জলাভূমি ধান, মাছ, বন, পাখির বিরল ভান্ডার। প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকানির্ভর টাঙ্গুয়ার আশেপাশে ৮৮টি গ্রাম আছে। ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়া আজ অপবিত্রতার গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছে।
 
২০১২ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২-এর বেশি প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০-এর বেশি প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১০০০-এরও বেশি প্রজাতির অমেরুদন্ডী প্রাণীর আবাস এই হাওর। নিরাপত্তাহীনতার কারণে দিন দিন কমছে এর সংখ্যা। হিজল, করচ, বরুণ, বনতুলসী, নলখাগড়া, শালুক, শাপলাসহ ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে টাঙ্গুয়ায়। মানুষের আগ্রাসী কর্মকান্ডে উজাড় হচ্ছে এসব উদ্ভিদ বা বনাঞ্চল।
 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরে এখনও থেমে নেই অবাঞ্ছিত কর্মকান্ড। এ জন্য টাঙ্গুয়ায় ভেসে বেড়ানো বিলাসী হাউসবোটগুলোই অনেকাংশে দায়ী মনে করছে সচেতন মহল। ভ্রমণের নামে সওয়ার হওয়া শহুরে জুটির উন্মাদনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে হাউসবোটের লোকজন। পর্যটকের চাহিদামতো মদ-গাঁজাসহ নিষিদ্ধ পণ্য সরবরাহের কাজ করছে তারা। স্থানীয় মাদক কারবারীদের যোগসাজশে এমনটা হচ্ছে অভিযোগ অনেকের। মদের বোতল হাতে তরুণীর ফেসবুক দৃশ্য টাঙ্গুয়ার বাস্তব পরিস্থিতিরই জানান দিয়েছে।
ফেসবুকে ছড়ানো ‘সুন্দরী রুমী’ নামক তরুণীর টাঙ্গুয়াকেন্দ্রিক ছবির মন্তব্যে মুজিবুর রহমান লিখেন, ‘হাউসবোটের মাঝি থেকে পরিচালনাকারী সকলেরই মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারলে এসব বন্ধ হবে।’
প্রতিবাদ জানিয়ে ‘আব্দুল হামিদ’ নামের একজন কমেন্টসে লিখেন, টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের গৌরব, অপসংস্কৃতির নয়। পর্যটকের ছদ্মবেশে নৈতিকতা ধ্বংসকারীরা হাওরের প্রকৃতি-পরিবেশের শত্রু। মদের বোতল আর অশ্লীলতার জন্য নয় হাওরের এই প্রকৃতি। অতি শীঘ্রই পর্যটন এবং হাউসবোট বন্ধের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন।
মিঠাপানি, মাছ, গাছ, পাখির দুর্লভ এই অভয়াশ্রম ধ্বংসে সবাই আঁটসাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে। হাওরের বজরায় নাচ-গান, মদ-গাঁজাসহ অসামাজিক কর্মকান্ড চললেও প্রশাসন এক্ষেত্রে নির্বিকার বলছে স্থানীয়রা।
ওয়াচ টাওয়ারের পার্শ্ববর্তী জয়পুর গ্রামের কপিল নূর বলেন, মাঝখানে ঝামেলা হওয়ার পর থাইক্যা নৌকা ছিতরা (এলোমেলো) গেছে। বড় বড় নৌকাও আইয়ে। ওয়াচ টাওয়ার, গোলাবাড়ি, আলংডোয়ারের কান্দা, আমরার গ্রামের উত্তরে হাউসবোট থাকে।
তিনি বলেন, আমরা তো আম (সাধারণ) মানুষ, কোনতা বুঝি না। একসময় নাওয়াইন লইয়া (নৌকা নিয়ে) যাইতাম। কামাই-রোজগার হইত। এই সুযোগ-সুবিধাডা মাঝিরা (হাউসবোট চালক) নিয়া নিছে। চা-নাস্তা, রান্দা-খাওয়া হাউসবোটে লইয়া আইয়ে। আরও কতকিছু আইন্যা দেয় তারা। আগে লোকজন আইয়া আমরারে পাক করার দায়িত্ব দিছে। পাঁচশ-এক হাজার টেকা দিছে। এইডা এখন বন্ধ হইয়া গেছে।
আক্ষেপের সুরে তিনি আরও বলেন, আগের তনে বহুত পরিবর্তন হইয়া গেছে। মাছ রোজির পথ আমরার একবারে বন্ধ। হাওরে মাছ নাই। আমরার কিইন্যা মাছ খাওন লাগে। এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হইলে আমরা পোলাপান কামাই-রুজি কইরা চলতে পারলনে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক পরিবেশকর্মী বলেন, ছোট-বড় সব নৌকাই তো চলছে। মাদক হাতে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির যে ভিডিও ফেসবুকে ঘুরছে, এ রকম ছবিতে গ্রামের মানুষ অভ্যস্ত না। এটা হাওরাঞ্চলের সুস্থ্য সংস্কৃতির পরিপন্থি।
 
তিনি বলেন, এই মদের বোতল স্থানীয়ভাবেই সরবরাহ করা হয়। কেউ শহর থেকে আনে না। পুলিশ, মাদক কারবারী, হাউজবোটের লোকজনই জড়িত। এ রকম আওয়াজ উঠেছে। কার্যকরী পদক্ষেপ যেহেতু নেই, সেহেতু মিলেমিশেই সবকিছু হচ্ছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার পর টাঙ্গুয়ার শুধু অবনতিই হয়েছে। প্রশাসনের পদক্ষেপ কাগজে-কলমে ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে সন্তোষজনক কোন কার্যক্রম নেই। ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
পরিচয় গোপনের শর্তে হাউসবোটের এক কাঠমিস্ত্রি জানিয়েছেন, নৌকার মালিক পক্ষই মডেলদের আনে বিজ্ঞাপন তৈরির জন্য। হাওরের বিভিন্ন লোকেশনে বিভিন্ন নমুনায় ভিডিও তুলে পর্যটক আকর্ষণের জন্য সেই ভিডিও অনলাইনে প্রচার করে তারা। বেশি বেশি প্রচারের জন্য অনেক সময় মডেলরাও তাদের ফেসবুক থেকে এসব ভিডিও ছাড়ে। এ রকম বাস্তব চিত্র নিজ চোখে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
 
হাওরে নৌকা চলতে বাধা নেই, ওয়াচ টাওয়ারের গাছে নৌকা না বাঁধলেই হয় স্বীকার করে হাউসবোট ‘গলই’র ম্যানেজার সুমন বলেন, মাদকের বোতল হাতে মডেলের ভিডিওটা আমি দেখেনি। মডেল এনে ছবি তোলা, ভিডিও করা আমার নৌকায় হয় না। অন্য নৌকায় হয় কিনা জানি না। ২০২২ সালে আমাদের নৌকায় বসুন্ধরার মালিক আসছিল। এ পর্যন্ত আর কোন সেলিব্রেটি আমার নৌকায় আনা হয়নি।
 
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসহ হাওরে অশ্লীলতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, প্রশাসনের নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। মাদক হাতে তরুণীর খোলামেলা ভিডিওচিত্র আমাদের সামাজিকতা বিরোধী। প্রকাশ্যে মদের বোতল দেখে প্রশ্ন জাগে। এগুলো কোথা থেকে আসে, কে দিচ্ছে? যদিও সরাসরি বলা মুশকিল, তবে ধারণা করা যায় স্থানীয়ভাবেই এর সরবরাহ হচ্ছে। এ জন্য প্রশাসনের জোর মনিটরিং দরকার।

হাওরে তরুণীর উন্মাদনার বিষয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, প্রকৃতি আমাদের বাঁচালেও আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করেও প্রকৃতিকে বাঁচাতে পারছি না। শুধুমাত্র দায়িত্বহীন কর্মকান্ড ও উদাসীনতার কারণে টাঙ্গুয়া অপবিত্র-উচ্ছৃঙ্খলতার শিকার হচ্ছে। হাওর রক্ষায় প্রশাসনের আইন প্রয়োগে দুর্বলতা আছে, কঠোরতা নেই। স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন উভয়কে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
 
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবুল হাসেম বলেন, টাঙ্গুয়ায় অস্থিতিশীল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা চলছে। নিয়মমাফিক চলাচলের জন্য অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বিলবোর্ড-লিফলেটেও প্রচার কাজ চলছে।
মাদক হাতে তরুণীর ভিডিও প্রশ্নে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। পুলিশ মাদক গ্রহণ ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করছে। এ ধরনের কর্মকান্ড যেন হাওরে না হয়, সে ব্যাপারে অনেককে সতর্ক করা হয়েছে।
 

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com