পার্লামেন্ট হিল অটোয়া: সুখেন্দু সেন

আপলোড সময় : ১৯-০৭-২০২৫ ১২:২৬:৩৪ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ১৯-০৭-২০২৫ ১২:২৬:৩৪ পূর্বাহ্ন
সুখেন্দু সেন:: অটোয়া নদীর দক্ষিণ তীরে পার্লামেন্ট হিলে কয়েকটি প্রাচীন সুরম্য ভবন নিয়ে কানাডার ফেডারেল পার্লামেন্ট অবস্থিত। এটি কানাডার জাতীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এবং একটি আকর্ষণীয় দশর্নীয় স্থান। বছরে প্রায় ত্রিশ লক্ষ পর্যটক পার্লামেন্ট হিলে আসেন। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করতে হয়। অনেকটা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মত কোমরের বেল্ট, হাতে রাখা জিনিজপত্র, মোবাইল, মানিব্যাগ সবকিছুই সতর্কতার সাথে স্কেনিং করা হয়। ইলেকট্রনিক ডিটেকটর দিয়ে শরীরও ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়। কানাডার নাগরিকদের জন্য তাদের পরিচয়পত্র গ্রহণযোগ্য হলেও বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি কার্ড এমন সংবেদনশীল জায়গায় কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম। পাসপোর্ট সঙ্গে থাকলেও একটা কথা ছিলো। সেখানে কানাডা সরকারের ভিসা স্টাম্প রয়েছে। কিন্তু সেটিও সঙ্গে নেই। যাই হোক ভেতরে প্রবেশের জন্য বেশ দ্বিধা নিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। রিসিপশন কাউন্টারে ভদ্রমহিলার হাতে আইডি কার্ডটি ধরিয়ে দিলে খানিক পরখ করে পরীক্ষণ যন্ত্রে স্থাপন করে হাসিমুখে আমার ফার্স্ট নেম জানতে চাইলেন। এখানে সেবাদাতারা সবাই হাসি মুখে কথা বলেন। ভাষার অবোধ্যতায় কখনও বিরক্তি প্রকাশ করেন না। আর খুব নি¤œস্বরে কথা বলেন। এটি তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নাম বলে উদ্বিগ্ন চিত্তে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। উনি তখন কম্পিউটারে নিমগ্ন। এবার মুখ তুলে মিষ্টি হেসে বললেন ও-কে। আমার বুকের গভীর হতে একটা নিঃশব্দ উচ্চারণ বেরিয়ে এলো - ও আমার বাংলাদেশ, তোমার এই একটি ছোট পরিচয়পত্র হাজার হাজার মাইল দূরের একটি উন্নত দেশে কতোটা গুরুত্বের সাথে তাদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে আমাকে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়ে দিলো। যান্ত্রিক শব্দ তুলে আমার নাম লিখা একটি আঠাযুক্ত টোকেন বেরিয়ে এলো। এটিই পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের ছাড়পত্র। আইডি কার্ডটি বুকপকেটে রেখে টোকেনটি সার্টের গায়ে সেটে দিয়েছি। এই প্রথম আমার দেশের আইডি কার্ডের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব টের পেলাম। একটা বিজয়ের আনন্দ যেন অনুভূত হচ্ছে। হৃদয়ে ঢেউ তুলছে পদ্মা, মেঘনা, সুরমা। বুক পকেটে আইডি কার্ড নয়, যেন পুরো বাংলাদেশ বুকে ধরে আমি কানাডার পার্লামেন্ট ভবন ঘুরে দেখছি। দেখছি আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, হাউস -অব- কমন্স, কমিটি রুম, মেমোরিয়াল চেম্বার, হল-অব-অনার ইত্যাদি। গ্যালারিতে সকল প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারের পোর্টেট। এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেলো। পরিচিত নাম, পিয়েরে ট্রুডো। প্রকৃত নাম জোশেফ ফিলিপ পিয়ের ইভেস এলিয়ট ট্রুডো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কানাডার সরকার ও পার্লামেন্টেরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। আমেরিকার প্রতিবেশী হয়েও নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বাংলাদেশের জন্মলগ্নে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। প্রথমে তিনি একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে প্রেরণ করেন। তিন সদস্যবিশিষ্ট সংসদীয় কমিটি সীমান্ত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে ভারতে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুঃসহ অবস্থা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন ১৯ জুলাই কানাডার সংসদে পেশ করেন। প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্যও কানাডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে এমনি এক দিনে যে সংসদ ভবনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আলোচনা হয়েছিলো, যে সংসদের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন সীমান্তে, যে সংসদের নেতা হানাদার পাকিস্তানের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করেছিলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে বক্তব্য রেখেছিলেন আমি সেই সংসদ ভবনই ঘুরে দেখছি।বুক পকেটে সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া পরিচয়পত্র। গর্ববোধ করছি। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয়া দেশ, যে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের সমর্থন ছিল, সেই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি একটি উদার, উন্নত, গণতান্ত্রিক সভ্য দেশের পবিত্র পার্লামেন্ট ভবনে দাঁড়িয়ে আছি। ছুটির দিন না হলেও দর্শণার্থী আছে বেশ। পাঁচ মিনিট অন্তর একেকটি গ্রুপে একজন গাইডসহ ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের গ্রুপের গাইড ছিলেন ফ্রেঞ্চ। ইংরেজিভাষী গাইড পেতে হলে আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হতো। সে সময় হাতে ছিলো না। গাইড অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু বুঝানোর চেষ্টা করলেও ফরাসী ভাষা কিছুই বোধগম্য হলো না। এতে তেমন অসুবিধা হয়নি। আগেই ওয়েটিং রুমে বসে বড় স্ক্রিনে স্থির চিত্রের মাধ্যমে মূল ভবনের কোথায় কী আছে, সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের একটা ধারণা পেয়ে গেছি। আমরা এখন পাঠশালার অমনোযোগী ছাত্রের মত শিক্ষকের কথায় কান না দিয়ে কেবল ছবিই তুলে যাচ্ছি। কানাডার পার্লামেন্ট হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা। রাজধানী অটোয়ার পার্লামেন্ট হিলে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবনটি কানাডার জাতীয় প্রতীক রূপেও বিবেচিত। পার্লামেটের তিনটি প্রধান ভবন সেন্টারব্লক, ওয়েস্টব্লক এবং ইস্টব্লক নামে পরিচিত। সেন্টার ব্লকের সুউচ্চ মিনারটিকে ‘পিস টাওয়ার’ বলা হয়। ১৯১৬ সালে অগ্নিকা-ে সংসদভবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং কয়েকজনের মৃত্যুও ঘটে। পরবর্তীকালে সময় ও প্রয়োজনের সাথে সংগতি রেখে নানা সংস্কার ও নির্মানের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় রূপান্তরিত হয়। ২০০৮ সালে নতুন করে গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম এখনও চালু আছে যা আরো তিন বছরে সম্পন্ন হবে। ১৮৫৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মহারাণী ভিক্টোরিয়া অটোয়াকে কানাডার রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করার পর ১৮৫৯ সালে পার্লামেন্ট ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৮৭৬ সালে স¤পন্ন হয়। বেলে পাথর ও স্লেট দিয়ে তৈরি কাঠামোগুলো গথিক স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। প্রাচীন ও আধুনিক চিত্র ও শিল্প কর্মের আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও বিভিন্ন সংগ্রহ বাস্তবিক অর্থেই চিত্তাকর্ষক। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই ‘বৃটিশ নর্থ আমেরিকা আ্যক্ট’ এর মাধ্যমে কানাডা ডোমিনিয়ন (আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্ত শাসন) প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরের ৬ নভেম্বর প্রথম পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হয়। এই আ্যক্টই কানাডার সংবিধান নামে পরিচিত। বর্তমানে ১ জুলাইকে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে ‘কানাডা দিবস’ হিসেবে সাথে পালন করা হয়। রাজা, সিনেট ও হাউস অব কমন্স নিয়ে কানাডার পার্লামেন্ট গঠিত। বৃটেনের রাজা কানাডা ফেডারেলের সাংবিধানিক প্রধান। রাজার নির্বাচিত একজন গভর্নর জেনারেল রাজপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁর সংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে গৃহীত বিল সাধারণত রাজা বা তাঁর প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেলের অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হয়। গভর্নর জেনারেল সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও পরবর্তী নির্বাচনের জন্য সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ ফেডারেল মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ করান। বর্তমানে সংসদের নি¤œকক্ষ হাউস-অব-কমন্সে ৩৩৮ জন নির্বাচিত সদস্য এবং উচ্চকক্ষ সিনেটে ১০৫ জন সদস্য রয়েছেন। ২০২৫ সালে ৪৫তম পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হলে দীর্ঘ কয়েক যুগ পর রাজপ্রতিনিধির পরিবর্তে স্বয়ং রাজা তৃতীয় চার্লস সংসদের প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে রাজসিংহাসন থেকে রাজকীয় ভাষণ প্রদান করেন। সম্প্রতি মার্কিন আগ্রাসনের হুমকির মুখোমুখি কানাডার জন্য এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রায় ৪০ মিনিট পার্লামেন্ট ভবনের সেন্টার ব্লক ঘুরে বেড়িয়ে এলাম। গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদ। প্রাঙ্গণজুড়ে সবুজ ঘাসের মখমল পাতা। ম্যাপল গাছের ছায়ায় বসে ভাবলাম ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়া কানাডার জাতীয় এই ঐতিহ্যের প্রতীকটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপনাগুলোর একটি নিদর্শন শুধু নয় এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও একটি তীর্থ স্থান। নানা জাতি-গোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণের বিচিত্র সংস্কৃতির এই বিশাল দেশের যে সকল আইন এ সংসদে প্রণীত হয় তা সকল নাগরিক কী নিষ্ঠায় পালন করে যাচ্ছে। সবাই কেমন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই আইনই নাগরিকদের মূল্যবোধকে কত উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশটাকে তাঁরা কত শান্তি ও স্বস্তির জায়গায় নিয়ে গেছে। সার্থক তাদের পার্লামেন্ট হাউস, সার্থক গণতন্ত্র।

সম্পাদকীয় :

  • সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি : মো. জিয়াউল হক
  • সম্পাদক ও প্রকাশক : বিজন সেন রায়
  • বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মোক্তারপাড়া রোড, সুনামগঞ্জ-৩০০০।

অফিস :

  • ই-মেইল : [email protected]
  • ওয়েবসাইট : www.sunamkantha.com