
সুনামগঞ্জের ছাতককে উৎপত্তিস্থল ধরে রবিবার যে ভূমিকম্পটি অনুভূত হলো, তা মাত্র ৪ মাত্রার স্বল্প শক্তির হলেও এটি এক গভীর সতর্কবার্তা। এর আগে মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিয়েছিল আসাম রাজ্য থেকে। ধারাবাহিক এই ভূমিকম্প আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরছে- বাংলাদেশ বিশেষত সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অঞ্চল এখন ভূমিক¤েপর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অঞ্চলটি তিনটি প্রধান টেকটোনিক প্লেট- ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ প্লেটের সংঘর্ষস্থলে অবস্থিত। শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি। ফলে ভূগর্ভে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা ৮ থেকে ৯ মাত্রার ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ডাউকি ফল্ট এলাকাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এক দুর্যোগের সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে ছাতককে উৎপত্তিস্থল ধরে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প আমাদের জন্য নিছক বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়; এটি আমাদের টিকে থাকার প্রশ্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বহুতল ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণে যথাযথ ভূমিকম্প সহনশীল নকশা মানা হচ্ছে না। দায়সারা মনোভাবে নির্মিত এসব ভবন মাঝারি আকারের ভূমিকম্পেই ধসে পড়তে পারে। এতে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করবে। আজ যদি আমরা প্রস্তুত না হই, তাহলে আগামী দিনে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়কে আমরাই আহ্বান করব।
সচেতন মহল এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত পরিষ্কার- প্রথমত, ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পৌরসভা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ভবন অনুমোদনে কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, জনগণকে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষিত ও সচেতন করা জরুরি। স্কুল, কলেজ, অফিস, আবাসিক এলাকাসহ প্রতিটি স্তরে ‘মক ড্রিল’ চালু করতে হবে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতা সভার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও এটি যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া বড় বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতির বিকল্প নেই। ছোট ভূমিক¤পগুলো যদি বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হয়, তবে এখনই আমাদের সচেতন হয়ে ওঠার সময়।
বাংলাদেশ আজ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে। আর এই ঝুঁকিকে হেলাফেলা করার মানে হবে অজানা এক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাই সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী ও সাধারণ মানুষ - সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। আজ যদি আমরা প্রস্তুতি নিই, কাল হয়তো প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা সম্ভব হবে। অন্যথায় ইতিহাস সাক্ষী থাকবে- সতর্কবার্তা আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু দায়িত্ব পালন করিনি।